ভুয়া ট্রাভেল এজেন্সি খুলে প্লেনের টিকিট বিক্রি করে পরে যাত্রীকে না জানিয়ে টিকিট রিফান্ড করে অর্থ হাতিয়ে উধাও হয়ে যেতো একটি চক্র। পরে ওই যাত্রী বিমানবন্দরে গিয়ে জানতে পারতেন তার টিকিট বাতিল হয়েছে। তখন চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকতো না যাত্রীর। প্লেনের টিকিটের নামে অহরহ মানুষকে ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতানো এই চক্রের মূল টার্গেট ছিল সামনের হজ মৌসুম।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) গুলশান বিভাগের একটি টিম বিশেষ অভিযান চালিয়ে প্লেনের টিকিট জালিয়াতি চক্রের এক সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতার প্রতারকের নাম মাহবুবুর রশিদ (৫১)। বুধবার (১১ মে) রাজধানীর কলাবাগানের গ্রিনরোড এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে বিভিন্ন এয়ালাইন্সের ৮১টি ভুয়া টিকিট, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত দুইটি মোবাইল ফোনসেট, দুইটি কম্পিউটার, একটি কালো রঙের জিপগাড়ি, ১২টি বিভিন্ন ব্যাংকের চেক ও একটি এটিএম কার্ড উদ্ধার করা হয়।
বৃহস্পতিবার (১২ মে) দুপুরে মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার।
তিনি বলেন, গত ২৬ মার্চ সাইদুর রহমান নামের এক ভুক্তভোগীর সঙ্গে প্রতারক মাহবুবুর রশিদের পরিচয় হয়। এ সময় মাহবুবুর নিজেকে এমকিউ ট্রেড অ্যান্ড ট্রাভেল কনসালটেন্সি নামক প্রতিষ্ঠানের সিইও বলে দাবি করেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টিকিট ক্রয় করে যাত্রী বিদেশ পাঠান বলে জানান। তখন সাইদুর তার পরিচিত পাঁচজনের মাস্কট, রিয়াদ এবং টরেন্টোর বিমানের টিকেট লাগবে বলে জানান। পাঁচজনের টিকিট বাবদ প্রতারক মাহবুবকে পাঁচ লাখ ১০ হাজার টাকা প্রদান করলেও প্রথমত মাস্কট এবং রিয়াদের দুটি টিকিট প্রদান করে। কিন্তু রিয়াদের যাত্রী গত ২৮ মার্চ এয়ারপোর্টে এসে দেখেন তার টিকিট বাতিল হয়ে গেছে। টিকিটিং এজেন্সি টাকা রিফান্ড করে উঠিয়ে নিয়ে গেছে বলে জানতে পারেন সাইদুর।
এরপর মাহবুবুর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে পরে আবার দুইটি টিকিট ইস্যু করে দিলেও ফ্লাইটের দিনে সাইদুর জানতে পারেন এই টিকিট দুইটিও রিফান্ডেড। পরে টরন্টোর টিকিট ইস্যু না করেই গ্রেফতার মাহবুবুর রশিদ অফিস গুটিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে যান। এরকম আরও কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে এবং অন্যান্য প্রতারণার সংবাদে ডিবি গুলশান তদন্ত শুরু করে।
প্রতারক মাহবুবুর রশিদ নানা নামে ফেসবুক আইডি ও পেজ খুলে বিভিন্ন দেশে গমনাগমন, ওমরা পালন, সিঙ্গেল টিকিট, আপ-ডাউন টিকিট, পরিবারের সদস্যদের বিমানের টিকিটের বিজ্ঞাপন দিতেন। কোনো বিদেশ যাত্রীর টিকিটের প্রয়োজন হলে বা কোনো গ্রাহক রাজি থাকলে তার কাছ থেকে হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুক চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে যাত্রীর পাসপোর্টের ছবি নিতেন।
এরপর মাহবুবুর রশিদ দুবাইয়ে অবস্থিত বাংলাদেশি নাগরিক সাদের মাধ্যমে দুবাই থেকে ও পাকিস্তানের করাচির আল-গাফফার ট্রাভেলস, আনোয়ার সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড, জে এ এস ট্রাভেলস, ভাওয়ালপুর এলাকার ফ্লাই-লিংক ট্রাভেলস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টিকিট সংগ্রহ করে মাহবুবকে হোয়াটসঅ্যাপে/মেইলে পাঠান। কখনো কখনো বুকিং কনফার্ম করে এবং যাত্রীদের টিকিটের আইটেনারি প্রদান করে (যেখানে যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নাম্বার যাত্রা বিবরণী ইত্যাদি থাকে) টাকা নিতেন।
ডিবি প্রধান বলেন, চক্রটির প্রধান মাহবুবুর রশিদের সহযোগী জাহাঙ্গীর বিভিন্ন ক্লায়েন্ট সংগ্রহ, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ও বিভিন্ন ট্রাভেলিং অ্যান্ড ট্যুর এজেন্সির সঙ্গে সমন্বয়, প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাতকৃত টাকা গ্রহণ ও বন্টনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। টিকিট বিক্রি করে প্রতারণাসহ নানা প্রতারণার ঘটনায় আসামির বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা রাজধানীর ভাটারা, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, কলাবাগান ও নিউমার্কেটসহ থানায় ৬টি মামলা রয়েছে। পুরনো আরও ৩টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।
অফিস পরিবর্তন
প্রতারক মাহবুবুর রশিদ ২০১৫ সালে কানাডায় লোক পাঠানোর কথা বলে মানুষকে জিম্মি করে টাকা আদায় করার অভিযোগে মোহাম্মদপুর থানা এবং ধানমন্ডি থানায় মানবপাচারের দুটি মামলা হয়। এ সময় তার প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল প্লানেট ওভারসিজ। এই লাইনে কাজ করতে করতে একসময় তার মাথায় বিমানের টিকিট প্রতারণার কৌশল মাথায় আসে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতারণাকাজের জন্য একাধিকবার অফিস পরিবর্তন করেন। ২০১৫ সালে মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়ায়, ২০১৮ সালে কারওয়ান বাজারে, ২০২১ সালে এলিফ্যান্ট রোডে এবং সর্বশেষ বসুন্ধরা এলাকায় তার সাময়িক অফিস স্থাপন করেন।
ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার
মাহবুবুরের অন্যান্য প্রতারণা
তিনি দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান/চাল ব্যবসায়ীদের তৈরিকৃত চালের নমুনা ও ঠিকানা সরবরাহ করার কথা বলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে চাল সরবরাহের ওয়ার্ক অর্ডার গ্রহণ করতেন। ব্যক্তি, কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানকে টনে টনে চাল দেওয়া কথা বলে অগ্রিম ৫০ শতাংশ টাকা নগদ অর্থ গ্রহণ করতেন। এভাবে গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ভুক্তভোগী আবুল ফজলের কাছ থেকে চাল সরবরাহের কথা বলে ১৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন তিনি।
যে সর্তকতা অবলম্বন জরুরি
ভুয়া ও প্রতারক টিকিটিং ও ট্রাভেল এজেন্সির হাত থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য যাত্রীদেরকে টিকিট কেনার ক্ষেত্রে টিকিটিং ও ট্রাভেলিং এজেন্সির কাছ থেকে টিকিট কিনতে হবে। যারা আইএটিএ (অর্থাৎ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রান্সপোর্ট এজেন্সিস) অথবা এবিএটি (অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্সিস অব বাংলাদেশ) তাদের কাছ থেকে কিনতে হবে। আইএটিএভুক্ত এজেন্সিগুলো এয়ারলাইন্সের সঙ্গে চুক্তি করার সময় তারা একটি বড় অংকের টাকা নিরাপত্তা জামানত হিসেবে দিয়ে রাখে, ফলশ্রুতিতে এসব টিকিটিং/ট্রাভেল এজেন্সি পালিয়ে যেতে পারে না এবং মানুষের সঙ্গে জালিয়াতি করতে পারে না। টিকিট করার ক্ষেত্রে আইএটিএ ভুক্ত বা এবিএটি ভুক্ত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টিকিট ক্রয় করা জরুরি। এছাড়া ভ্রমণের ন্যূনতম দুইদিন আগে নিজের টিকিট কনফার্ম করা অর্থাৎ টিকিটটি ইনভ্যালিড (বাতিল) হয়ে গেছে কি না তা পরীক্ষা করা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) কামরুজ্জামান সরদারের নিদের্শনায় অভিযান পরিচালিত হয়। গুলশান জোনাল টিমের টিম লিডার সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) খলিলুর রহমানের নেতৃত্বে অভিযানটি পরিচালিত হয় বলেও জানান এ কে এম হাফিজ আক্তার।