নির্বাচন ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব না। মাছের বেঁচে থাকার জন্য যেমন পানি দরকার, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক দলের জন্য দরকার নির্বাচন। গণতন্ত্রে সরকারি ও বিরোধী দল উভয়ের দায়িত্ব আছে। কেউ নির্বাচনে আসবে না, কিন্তু বলে বেড়াবে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে গেছে, এটা তো ঠিক না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট শুরু হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনার মধ্য দিয়ে। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই মোকাবেলা করতে হবে। এটা কখনো হত্যার মাধ্যমে নয়। মুক্তিযুদ্ধের ধারায় যদি দেশকে এগিয়ে নিতে হয়, তাহলে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এদেশকে এগিয়ে নিতে হবে।
বুধবার (১৮ মে) বেলা ১২টায় রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) নসরুল হামিদ মিলনায়তনে ‘আগামী নির্বাচন, রাজনৈতিক সংকট ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। মুক্ত আলোচনার আয়োজন করে যৌথভাবে বিবার্তা২৪ডটনেট ও জাগরণ টিভি।
আলোচনা সভায় প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন সকল দলের অংশগ্রহণমূলক হবে। বিএনপি বলেছে তারা নিবাচনে অংশ নিবে না। রাজনীতির মাঠে সুবিধা নেয়ার জন্য, দরকষাকষি করার জন্য এসব বলছে। হঠাৎ করে কেনো বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিবে না, এখন এই প্রশ্ন আসছে কেনো? কারণ তারা সরকারের উন্নয়ন মেনে নিতে পারেনি। এখন তারা নির্বাচন নিয়ে আন্দোলন, সংগ্রাম করতে চায়।
নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী ও যথা সময় হবে উল্লেখ করে হানিফ বলেন, আমরা চাই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হোক এবং সব দল অংশগ্রহণ করুক। সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে সরকারের যা যা করার প্রয়েজন সব করবে।
সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই উল্লখ করে তিনি বলেন, আমরা দেশের সকল মানুষকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। বিপদগ্রস্ত মানুষদের রক্ষা করাটা আমাদের দায়িত্ব। এদেশের কিছু মানুষের ভিতরে অস্থিতিশীলতা আছে। যার জন্য মাঝে মাঝে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটনা ঘটে যায়। শেখ হাসিনার সরকার যতদিন ক্ষমতায় আছে, ততদিন দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় শান্তিতে থাকতে পারবে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ চলছে, এর আগে করোনা ছিলো। এমন পরিস্থিতিতে পুরো বিশ্বর অথনীতি ধাক্কা খেয়েছে। বাংলাদেশ ছোট দেশ ধাক্কা লাগাটা স্বাভাবিক। শেখ হাসিনা যথেষ্ট ভালোভাবে দেশের অথনীতি সচল রাখতে সক্ষম হয়েছেন। প্রতিবছর রফতানি আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথনীতি নিয়ে বিচলিত হওয়ার সুযোগ নেই। বৈদেশিক মুদ্রার ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। আমাদের অথনীতি যথেষ্ট ভালো এবং আমরা স্বস্তিদায়ক অবস্থায় আছি।
শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, এদেশের সংকটগুলোতে বেশি আক্রান্ত হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। কাজেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এদেশের সকল আন্দোলনের সূতিকাগার। এদেশের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে দলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কাজেই সামনে কোনো সংকট আসলে দলটিকে পূর্বের ন্যায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তি একটা প্লাটফর্মে এসে দাঁড়াতে পারেনি। আওয়ামী লীগও সেটা করতে পারেনি। এদেশের মৌলবাদীদের আস্ফালন এখনো আছে। তার চেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে, তারা যুথবদ্ধ, তাদের কিছু জনপ্রিয়তাও আছে। এটাকে ইস্যু করে তারা এখনো এদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, আমি এখন দেশে কোন সঙ্কট দেখছি না। কিসের সঙ্কট? স্বাভাবিক নিয়মে নির্বাচন হবে। সরকার সেদিকেই যাচ্ছে। এজন্য নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রয়োজন ছিলো, সেটাও হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের এযাবৎ সকল কাজ বলে এটা একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন। ফলে সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচন চাচ্ছে। সুতরাং সঙ্কট না। সঙ্কট হলো, যারা সঙ্কট সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। তারা মূলত চাচ্ছে-দেশ শ্রীলংকা হয়ে যাক।
বিএনপি নির্বাচনের কথা বলছে উল্লেখ করে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। কিন্তু তারা নির্বাচনের কথা বলছে। তারা চাচ্ছে, তাদের বিদেশী প্রভূরা এসে তাদের ক্ষমতায় বসে দিয়ে যাবে। তারা গণতন্ত্রের কথা বলে। কিন্তু তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা (জিয়াউর রহমান) গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছেন। এটা আমার কথা নয়, সুপ্রিম কোর্টের রায়।
গ্লোবাল টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, সাংবাদিকতার বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সবচেয়ে নিচে আছে। এখন এসব আমরা গায়ে ধরে নিবো কি-না, উন্নয়ন করবো বিবেচনায় নিতে হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের উন্নয়ন হচ্ছে এবং মানুষ তা ভালোভাবে গ্রহণ করছে। সব উন্নয়নের বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছেছে কি-না এবিষয়টিও দেখতে হবে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক সরকার রাজনৈতিক নেতৃত্বে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিবে। আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত বাড়ছে। বাণিজ্য সচিব ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলছেন। পরে মন্ত্রী কথা বলছেন। এসব জায়গায় রাজনৈতিক সংকটের জায়গা নিয়ে চিন্তা করার বিষয় আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, প্রতিবছর নির্বাচনের আগে উদ্বেগ উৎকন্ঠার মধ্যে চলে যেতে হয়। আমি বলবো, নির্বাচন কমিশনের সাথে জড়িত নিবন্ধিত দলগুলো নির্বাচনে আসুক। তবে আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চাকে অনুধাবন করতে হবে। রাজনৈতিক চর্চা করতে হবে। রাজনীতি বাদ দিয়ে কোন কিছু চিন্তা করতে পারি না। তবে এক্ষেত্রে আমাদের রাজনীতিবিদদের অনেক দায়িত্ব। তাদের মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক অস্থিরতা শুধু বিরোধী দলের সাথে হবে বিষয়টি এমন নয়, বরং এটা দলের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয়ের কারণে হতে পারে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ নারী। আর এ নারীদের ৩৩ শতাংশ আসন দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু মেজর পলিটিক্যাল দল নারীদের কতটুকু জায়গা দিচ্ছে। ভাইয়েরা কি প্রস্তুত, বোনদেরকে ছেড়ে দিতে। স্বাধীনতার ৫০ বছর। সবাইকে নিয়ে, সকল রাজনৈতিক দল মাঠে আছেন। কিন্তু এরপরেও অনেকে বলছে গণতন্ত্র বিপন্ন। তাদেরকে বলতে হবে যে, তোমরা না আসলে কথা বলবা কিভাবে?
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি কাজল দেবনাথ বলেন,ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রাজনীতিতে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। রাজনীতিতে আজকে একজনের প্রতি আরেকজনের আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়েছি। বিশ্বাস রাখতে পারছি না। রাজনীতি কি জনগণের, না কি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য?
৭০ নির্বাচন এবং ৭ মার্চের ভাষণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে নিতে আমাদের কোন পয়সা দিতে হতো না। কিন্তু এখন পোস্টার লাগাতেও টাকা লাগে। কারণ পঙ্কজ ভট্টাচার্য মতো রাজনীতিবিদ এখন নাই।
নিউইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশী ডা. ফেরদৌস খন্দকার বলেন, একসাথে আলোচনার টেবিলে বসে সব সংকট সমাধান করা সম্ভব। আজকের আলোচনার বিষয় ঠিক করা হয়েছে, আগামীর নির্বাচন, রাজনৈতিক সংকট ও উত্তরণের উপায়। কিন্তু আমি এটিকে সংকট বলতে রাজি নই। এটি একটি সাধারণ অবস্থা। প্রতিবার নির্বাচনের আগে এটি সৃষ্টি হয়। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর রেস্পন্সিবল আচরণ করার প্রয়োজন হয়। ভবিষ্যতে আলোচনার মাধ্যমে এক্টিভ ফরম্যাটে ঠিক করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে।
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি রানা দাশ গুপ্ত বলেন, নির্বাচন ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন। মাছের জন্য যেমন পানি দরকার, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক দলের জন্য নির্বাচন দরকার। গণতন্ত্রে সরকারি ও বিরোধী দল উভয়ের দায়িত্ব আছে। কেউ নির্বাচনে আসবে না, কিন্তু বলে বেড়াবে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে গেছে, এটা তো ঠিক না।
রানা দাশ গুপ্ত বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট শুরু হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনার মধ্য দিয়ে। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। এটাকে হত্যার মাধ্যমে নয়। মুক্তিযুদ্ধের ধারায় যদি দেশকে এগিয়ে নিতে হয় তাহলে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এদেশকে এগিয়ে নিতে হবে। এসময় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা আইনের দাবিও জানান তিনি।
বিবার্তা২৪ডটনেটের সম্পাদক বাণী ইয়াসমিন হাসির সভাপতিত্বে জাগরণ টিভির প্রধান সম্পাদক এফ এম শাহীনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন- বাংলা জার্নালের প্রকাশকও বিবার্তা২৪ডটনেটের বার্তা সম্পাদক হাবিবুর রহমান রোমেল, গৌরব ৭১’এর সাংগঠনিক সম্পাদক রবিউল ইসলাম রুপম, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বরিকুল ইসলাম বাঁধন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান প্রমুখ।