অধ্যক্ষ কর্তৃক ৪ শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানীর অভিযোগ ক্যাম্পাসে ভাংচুর, উদ্ভুত পরিস্থিতি; সামাল দিতে প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা:: তোপের মুখে সাংবাদিকরা
দিনাজপুর চিরিরবন্দর প্রতিনিধি
দিনাজপুর চিরিরবন্দর উপজেলার আমেনাবাকী রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজে ১০ম শ্রেনীর দুই শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানীর অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। এমন অবস্থায় অধ্যক্ষকে ছুটি দিয়েছে বিদ্যালয় কমিটি।
এদিকে অধ্যক্ষ নির্দোশ দাবি করে ওই প্রতিষ্ঠানটির কিছু শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের বিক্ষোভ ও ভাংচুর করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যালয়টি আগামী শুক্রবার পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বিদ্যালয়ে এমন যখন অবস্থা, তখন সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে সংবাদকর্মীদেরকে।
জানা যায়, প্রায় ২০ দিন পূর্বে বিদ্যালয়ের ১০ শ্রেনীর এক শিক্ষার্থী তার বাবা-মাকে জানায় যে বিদ্যালয়টির অধ্যক্ষ তার গায়ে হাত দিয়েছে। এমন অভিযোগের পর ওই বাবা-মা মামলা করার প্রস্তুতি নিলে মেয়েটির চাচা, যিনি একজন জনপ্রতিনিধি, তিনি মামলা করার আগে বিষয়টি বিদ্যালয় পরিচালনার প্রতিষ্ঠান এবি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ডা. আমজাদ হোসেনকে অবহিত করেন। এরই মধ্যে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আরও ৩ জন শিক্ষার্থী যৌন হয়রানীর অভিযোগ তোলেন। এই ঘটনার জন্য তাৎক্ষনিকভাবে বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানকে ছুটি প্রদান করা হয়।
অধ্যক্ষের ছুটি চলাকালীন অবস্থাতেই গত ১৮ জুন রাতে বিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীরা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট উল্লেখ করে প্রথমে ছাত্রীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে তাদের সাথে ছাত্ররাও বিক্ষোভে যোগ দেন। এ সময় তারা বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ফুলের টব, গাছপালা, ভবনের জানালাসহ বিভিন্ন কিছু ভাংচুর করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে তাৎক্ষনিকভাবে চিরিরবন্দর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় এবং রাত প্রায় ১২ টার দিকে শিক্ষার্থীদেরকে বুঝিয়ে তাদেরকে হোষ্টেলে ফেরত পাঠায়। পরের দিন ১৯ জুন রোববার সকালেও শিক্ষার্থীরা আবারও বিক্ষোভের চেষ্টা করে। এ সময় বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সংশ্লিষ্টরা আগামী শুক্রবার পর্যন্ত বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয়। দুপুরের মধ্যেই বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীর অভিভাবককে বিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্ত জানিয়ে তাদের সন্তানদেরকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অবহিত করা হয়। পরে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদেরকে বিদ্যালয় থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
দিনাজপুর চিরিরবন্দর প্রতিনিধি
ছাত্রীদের যৌন হয়রানী ও হঠাৎ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণার পর রোববার বিকেলে আমেনা বাকী রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজে যায় জেলার ৮ জন সংবাদকর্মী। এ সময় প্রথমে গেটের মধ্যেই সাংবাদিকদেরকে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না বলে বাধা দেয়া হয়। পরে গার্ডকে বুঝিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে শিক্ষক কিংবা প্রশাসনের কারও সাথে কথা বলতে চাইলে সেখানে সাংবাদিকরা কার অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করেছেন এমন প্রশ্ন তুলে খারাপ ব্যবহার করেন শিক্ষক আব্দুর রউফ, তোহাসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক। পরে তাদেরকে উদ্ভুদ পরিস্থিতি কেন জানতে চেয়ে দায়িত্বশীল কারও সাথে কথা বলার অনুরোধ জানানো হয়। এ সময় একটি শ্রেনীকক্ষে ৪ জন সাংবাদিকসহ ৮ জন সংবাদকর্মীকে বসতে দেয়া হয়। প্রায় ঘন্টাখানেক অতিবাহিত হলেও কেউ আর কথা বলতে আসেনি। পরে সেখান থেকে বের হয়ে সাংবাদিকরা কয়েকজন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে কথা বলতে এগিয়ে গেলে আবারও শিক্ষকরা সাংবাদিকদের বাধা প্রদান করেন। এ সময় দেখা যায় যে, আবাসিক শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
এ সময় অশান্ত ঘোষ নামের এক অভিভাবক বলেন, কেন স্কুল বন্ধ দেয়া হয়েছে তা আমাদেরকে জানানো হয়নি। শুধু ফোন করে বলা হয়েছে এখুনি আপনার বাচ্চাদের নিয়ে যান। এজন্য স্কুলে এসে আমার দুই মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে ফিরছি।
শরিফুল ইসলাম নামে এক অভিভাবক বলেন, শুনেছি মেয়েদের গায়ে হাত দেয়া হয়েছে এমন একটি ঘটনা আছে। তবে বিস্তারিত জানি না।
কথা হলে চিরিরবন্দর থানার অফিসার্স ইনচার্জ বজলুর রশিদ বলেন, শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করছে এমন বিষয় অবহিত হওয়ার পর আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে একাধিক শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলি। পরে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও শিক্ষকদের সাথে কথা বলি। বিদ্যালয়ের কম্পিউটার ল্যাবে একজন শিক্ষার্থীর গায়ে নাকি হাত দিয়েছেন অধ্যক্ষ এমন অভিযোগ করেছেন ওই শিক্ষার্থীর পিতা। এই বিষয়টি জেলার একজন জনপ্রতিনিধি অবহিত হওয়ার পর বিষয়টি এবি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানকে অবহিত করেন।
অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নবাবগঞ্জের একজন, পার্বতীপুরের একজন এবং অন্য উপজেলার ২ জন শিক্ষার্থীসহ মোট ৪ জন শিক্ষার্থী যৌন হয়রানীর অভিযোগ করেছেন। তবে বিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করছিলেন তাদের দাবি, অধ্যক্ষ নির্দোশ। অধ্যক্ষের স্ত্রী এই বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, এবং তাদের মেয়ে বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেনীতে পড়াশোনা করে। ওই মেয়ের বন্ধুরা মিলে অধ্যক্ষ নির্দোশ দাবি করে তাকে স্বপদে বহাল রাখার দাবি তোলে।
বিষয়টি তাৎক্ষনিকভাবে শিক্ষার্থীদেরকে বুঝিয়ে তাদের হোষ্টেলে ফেরত পাঠাই। তবে এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত আমার কাছে লিখিত কোন অভিযোগ দেয়া হয়নি।
কথা হলে বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা। বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থী আছে যার পায়ে ৬টি আঙ্গুল, এজন্য সে জুতা পড়তে পারে না। ওই শিক্ষার্থী একদিন আমাকে অভিযোগ করছিল যে সে জুতা পড়তে পারে না বিষয়টি নিয়ে ক্লাশ শিক্ষকরা তাকে বলেছিল যে সে কেন জুতা পড়ে না। পরে তার মাথায় হাত রেখে আমি বলেছি যে, মা তুমি চিন্তা করিও না। আমি অন্যান্য শিক্ষকদেরকে বিষয়টি বলে দিব। আর একদিন কম্পিউটার ল্যাবে আমি নাকি একজন শিক্ষার্থীর হাতে হাত রেখেছি। এখন শেখাতে গেলে হয়তো মাউসে হাত রেখেছি। কিন্তু সেখানে তো সিসি ক্যামেরা আছে। চাইলেই বাস্তব বিষয়টি দেখা যেতে পারে। আমার বিরুদ্ধে এখানে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কিছু ব্যক্তি আমাকে এখান থেকে সরিয়ে দিতে চায়। এটি এমনও হতে পারে যে, প্রতিষ্ঠানটিকে নষ্ট করে দেয়ার একটি চক্রান্ত।
দিনাজপুর চিরিরবন্দর প্রতিনিধি
বিদ্যালয়টির পরিচালনা কমিটির সদস্য এরশাদ আলী বলেন, একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা একটু উত্তেজিত হয়েছিল। এখন শিক্ষার্থীদেরকে নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়টিও আমাদের। এজন্য বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যৌন হয়রানীর অভিযোগ উঠেছে অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে। দিনাজপুরের একজন জনপ্রতিনিধি এই অভিযোগ করেছেন চেয়ারম্যানের কাছে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন না করলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করবেন বলে তিনি বলেছেন। যদি সত্যিই কোন অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে তাহলে আমরাও চাই উপযুক্ত বিচার হোক। এজন্য আমরা অধ্যক্ষকে ছুটি প্রদান করেছি এবং বিষয়টি অধিকতর তদন্ত করে দেখছি। অধ্যক্ষের স্ত্রীও এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকা। তিনি কিছু শিক্ষার্থীদেরকে নিজ আয়ত্বে নিয়ে অধ্যক্ষকে স্বপদে ফিরিয়ে দেয়ার আন্দোলন শুরু করেন। তবে একথাও সত্যি যে, অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান এই প্রতিষ্ঠানের জন্য অনেক অবদান রেখেছেন।
কথা হলে এবি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ডা. আমজাদ হোসেন বলেন, অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানের এই প্রতিষ্ঠানটির পিছনে অনেক অবদান আছে। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা স্পর্শকাতর। আমরা বিষয়টি অধিকতর তদন্ত করে দেখছি। এই সময় পর্যন্ত তাকে ছুটি প্রদান করা হয়েছে। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছে। এতে করে হয়তো এমন হতে পারে যে, নিজেদের দ্বারাই শিক্ষার্থীরা আঘাতের শিকার হতে পারে। এজন্য প্রতিষ্ঠানটি সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
কথা হলে ওই জনপ্রতিনিধি বলেন, ওই মেয়ে আমার ভাতিজি। আমি চেয়েছিলাম বিষয়টি বিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্বে থাকারাই সমাধান করবে। কিন্তু এখনও কোন সমাধান হলো না। এই ঘটনায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে এবং আমার জানামতে মোট দুটি মামলা একসাথে হবে।
উল্লেখ্য, দিনাজপুর আমেনাবাকী রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজে প্রায় ২২০০ এর অধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। যার মধ্যে অধিকাংশই আবাসিক।
দিনাজপুর চিরিরবন্দর প্রতিনিধি
দিনাজপুর। তাং-২০.০৬.২০২২ ইং।